ঝুমা চট্টোপাধ্যায়
এরপর কোথায় যাবো?
টোটালি সবার সংগে দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ। হোয়াটসঅ্যপে গ্রূপে, অবশ্য কথা টথা হয়, আড্ডা হয়। যে যেমন পারে পোস্ট দেয়, স্বরচিত কবিতা গান গল্প দেওয়া নেওয়াও চলে রেগুলার। ঠাট্টা ইয়ারকি করার জন্য এডমিনেরও ঢালাও পারমিশন । কিন্তু তবু যেন কোথায় ফাঁকা ঠেকে। মনের মধ্যে দমবন্ধ ভাব। গ্রুপ এর পোস্ট থেকে মন এদিক ওদিক উধাও হয়ে যায়। মাস্ক পড়েনি বলে শেয়ালদা স্টেশন চত্বরে দুই যাত্রীর মধ্যে প্রথমে বচসা ও পরে হাতাহাতি। শেয়ালদা স্টেশন!!। কল্পনায় শেয়ালদা স্টেশন চলে যাওয়াটা এমন কিছু বড় ব্যাপার না। এই স্টেশন থেকেই তো এককালে ঢাকা মেল ছাড়ত না? সেই ট্রেন ধরে প্রথমে গোয়ালন্দ , তারপর গোয়ালন্দ থেকে স্টিমার । পরদিন ভোর নাগাদ রাজদিয়া। সেখানে স্টিমার ঘাটায় উঁচু পাড় । পাড়ে পাড়ে সারা আকাশময় কালো-সাদা ডানার গাঙচিলেদের ভিড়। দিগন্তে ঘন সবুজ বনানী- নোয়াখালি জেলার মাল্লাদের হৈ-হল্লা , লাল সুরকি ছড়ানো উঁচু বাঁধের মতো রাস্তা …… । কালিগ্রাম, পতিসর, শিলাইদহ যাওয়ার গাড়িও কি এইখান থেকেই ছাড়ে? কে জানে? কিংবা সুজনগঞ্জের হাট? এদেশে ভাটির দেশ বলেও জায়গা একটা আছে শুনেছি। চারিদিকে শুধু জল আর জল । ছোট্টো একখান জেলে ডিঙি থাকলেই নাকি এসব দেশের যত্র তত্র অগাধ বিচরণ করা খুব সহজ । জন্মসূত্রে আমি বর্ধমান জেলার লোক, লেখাপড়া চাকরি কখনো বর্ধমান, কখনও দিল্লী। আমি কেন, আমার চোদ্দ পুরুষও কখনো পূর্ববঙ্গ যায় নি, যাওয়ার দরকারও পড়েনি। তবু এতোদিন পরে নোয়াখালি জেলার মাল্লারা আমার স্বপ্নে স্বপ্নে এসে আমাকে নিয়ে কোথায় যাত্রা করে কে জানে!
শ্রাবণের আজ চব্বিশ তারিখ। শুক্কুরবার। সুজনগঞ্জের হাটে আজ দেদার ভিড় । ভিড় হোক। ভিড়ের মধ্যে সামনা সামনি যেই এসে পড়ুক না কেন , অমনি দুদন্ড দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে খোশ গল্প সেরে নেওয়া যাবে। কথা গল্প করার জন্য অঢেল সময়। কারুরই কোনও ধুন্ধুমার তাড়া নেই। বাসাইলের চন্দ্র ভুঁইমালী, সিরাজদীঘার ফণী শেখ, হাসাড়ার মানু পাল, রসুনিয়ার গোঁসাইদাস সা, আরও কত নাম বলব? প্রাণ ভরে গল্প কথা কইতে না পেলে লোক গুলো স্রেফ মরেই যাবে। গঞ্জের হাটে হাট করতে এসেছে বটে কিন্তু জিনিষপত্র খরিদ করবার আগে পাঁচ জনের সঙ্গে মনের গল্প কথা সেরে নেবে না তা কি হয় ? নাকি কেউ কখনও এমন কথা শুনেছে , হাটে এলো আর তড়িঘড়ি সওদা বাজার শেষ করে উর্ধশ্বাসে বাড়ি ফিরে গেল ! আস্ত রাখবে বাড়ির লোক ? হাট ফিরতি মানুষটার কাছেই তো বাড়ির সক্কলে পাড়া পড়শির খবর জানতে চাইবে । কি জবাব দেবে তখন ? বলবে , একটা কোষা নৌকা , এক জোড়া হালের বলদ , আনাজ , মাছ, মশলাপাতি বেছে বেছে সমস্ত কিনেছি আর তারপর কোনোদিকে না তাকিয়ে সিধে বাড়ি ফিরে এসেছি। কত খরচ হল , আর কত বাঁচল তার হিসেব করার আছে না ! হিসেবে বাপু কোথথাও এতটুকু গরমিল পাবে না হুঁ হুঁ বাবা ! এক পয়সা এদিক ওদিক হওয়ার জো নেই। কোনো দিকে কোনও এক্সট্রা খরচ করিনি। যা জমবে সব দিয়ে নেক্সট মান্থে একটা সেন্ট্রাল কুলিং……। নাহ্ ! সুজনগঞ্জের হাটুরেরা এসব কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনা। ভাববার অত ক্ষমতাই নেই তাদের। প্রাণ খুলে বকবক করতে পারলেই খুশী তারা। হালের বলদ , আনাজপাতি এটা সেটা কেনার পর ঠাকুরঝির জন্য দুজোড়া থান, যুগলের জন্য গামছা, রামহরির ছোট মেয়েটার আসছে মাসে সাধ, মেয়েটার জন্য ভালো দেখে একটা কাপড় আর নতুন একজোড়া আলতা পাতা সব এক এক করে কেনা হয়। কেনবার সময় প্রথমে দোকানী যা দাম বলে শুনে মনটা দমে যায় বটে কিন্তু শেষমেষ দরাদরি করে কিনেই ফেলে জিনিষগুলো। নাড়কোল কেনে গন্ডা দশ বারো। দুর্গা পুজো আসছে সামনে। কিনতে ভুল হয়ে গেলে বাড়িতে আর আস্ত রাখবে না। কেঁদে কেটে ইনিয়ে বিনিয়ে বলবে, কেন যুগল কি এ সংসারের কেউ নয়? কটা জিনিষ বেশি কিনলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে ?
লোকটা মাঝবয়সী, গায়ের রং কুচকুচে কালো, মাথায় জটা পাকানো চুল, চিমসে গন্ধ ছারছে চুল থেকে। পরণে আধ ময়লা ধুতি আর ঢলঢলে ফতুয়া। সব সময় জলের কাছে থাকার জন্যই বোধহয় গা হাত পায়ের চামড়া রুক্ষ আর খসখসে। লোকটার কোলের কাছে টিনের ক্যাশবাক্স আর লাল রঙের হিসেবের খাতা। দেখতে পাওয়া মাত্রই মাচার তক্তোপোষ থেকে লাফ দিয়ে নেমে এল - আসেন আসেন বড়কত্তা !
যত বলি, এখন আর বসব না, অনেক দেরী হয়ে গেছে। কে শোনে কার কথা। - হেয়া ( তাই) কহনও হয়? আড়তে আপনের পায়ের ধুলা পড়লো , একদন্ড বইস্যা না গ্যালে…, তারপর আমার নাতির ( কাল্পনিক) দিকে চেয়ে , দা- ঠাউরের জন্য মাছ লইয়া যান ! আইজ জব্বর মাছ উঠতে আছে কত্তা ! দরও ঝপর ঝপর নামতা আছে। অহন টাকায় দশটা বিকাইতে আছে, রাইতের দিকে বিশটা কইর্যা বেচতে হইব !'’
তারপর নাতির দিকে চেয়ে – কই মাছ বাছলা না ?
প্রথমে মনে হয়েছিল ধানের ক্ষেত বুঝি একটানা দিগন্ত পর্যন্ত ছুটে গেছে। কিন্তু খানিকটা দূর যাওয়ার পর দেখা গেল ধানবন শেষ। তারপর শুধু জল আর জল। কাঁচের মত জল পারাপারহীন সমুদ্র হয়ে দিগবিদিকে ছড়িয়ে। এলোমেলো অস্থির বাতাসের কারণে জলের ওপর ছোটো ছোটো অবিরাম ঢেউ। এদিকে জলের ওপরে রাশি রাশি পদ্মপাতা ভাসছে। ঢেউ এর দোলায় সেগুলোও বেশ দুল দুল করে দুলছে । আছে শাপলা, নল খাগড়া, জল ঘাস, ঝাড় ওয়ালা ধঞ্চে আর কালো মুত্রার ঝোপ। আর আছে বউন্যা গাছ, কাউ ফলের গাছ, লাল ফুলে ভরা মান্দার গাছ। আকাশ যেখানে ধনুরেখায় মিলেছে, সারি সারি তালগাছ সেখানে এক পায়ে দাঁড়িয়ে। সমস্ত নিস্তব্ধ, নিঃঝুম ! শুধু ঢেউ এর ছলাৎ ছল্ ……
মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছে আর মনের মাঝে পাগল। শিরা উপশিরা ছিঁড়ে ফর্দা-ফাঁই । জানলার পাল্লাগুলো বহুদিন হয়ে গেল বন্ধ। মরচে পড়ে গেছে ওগুলোয়। একটা টিকটিকি ঘুরত দেওয়ালে , বাতাস আসে না বলে সেটাও মরে ভুত হয়ে গেছে। মরা টিকটিকির গন্ধ নিয়ে ফুলদানীটা একলাই টেবিলের এক কোণায় দাঁড়িয়ে।
সূর্য্য অস্ত গেছে।
Post a Comment