দিলীপ ফৌজদার
কোথা হইতে আসিয়াছ! কোথায় মিশিবে?
মানুষের চিন্তায় যেমন কয়েকটি আরম্ভ নিয়ে কোন স্পষ্ট ধারণা নেই তেমনি তাদের শেষ নিয়েও নেই স্পষ্ট কোন বোধ। খতিয়ে যদি দেখতে যাই তাহলে এই 'কয়েকটি'ই 'যাবতীয়' হয়ে ওঠে। আমরা জাগতিক, প্রচলিত কিছু ধারণা বোধ নিয়ে কল্পনা করে নিই যে সব কিছুরই একটা আরম্ভ আছে, একটা শেষও আছে।
এইভাবেই আমরা ভেবে নিই জন্মের কথা, মৃত্যুর কথা। এইভাবেই চিন্তাস্রোত আমাদেরকে টেনে নিয়ে চলে যায় বিশাল ধরাছোঁয়ার বিষয়বস্তু থেকে তার সূক্ষ্ম থেকে অতিসূক্ষ্ম অবস্থায় - দৃশ্য থেকে অদৃশ্যের রহস্যময়তায়। একটা বিশাল নদীর জন্মকথা খুঁজতে যাই সরল প্রশ্নে "নদি, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?" এইভাবে গঙ্গা হইতে ভাগীরথী হইতে, হিমালয় হইতে অজানা অভ্যন্তরের জল হইতে হিমপাথরে, পাহাড়ের শীর্ণ জলস্রোত হইতে সঙ্কীর্ণ গিরিখাতের হিমবাহে। দুটো বিশাল দার্শনিক পর্দায় এর ব্যবচ্ছেদ চলতে থাকে - এর প্রথমটায় চলে আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান, অনেকেই এই spiritual প্রশ্নটিকে ধর্মীয় আখ্যা দেন। অপরটি বৈজ্ঞানিক। এই scientific খোঁজটিরো প্রত্যন্তে আছে চিন্তার এক অপার গণিত।
এমনিতর একের সঙ্গে জুড়ে থাকা বহু প্রশ্ন আরো কয়েকটি আছে। পাহাড়ের জন্ম কিভাবে হয়েছে? পৃথিবীর জন্ম কি করে হোল? সূর্য দেবের কথা, নক্ষত্র মণ্ডলীর, ব্রহ্মাণ্ডের উদ্ভব এই সমস্ত কিছুরই খুটিয়ে দেখলে দেখব এদের না আছে আরম্ভ, না আছে শেষ। এরা এক অবস্থা বদলে অন্য অবস্থায় গিয়ে ফু্রিয়ে যায় আবার এদেরই থেকে স্বয়ম্ভু ব্রহ্মার মতো নতুন একটি আরম্ভের সূচনা হয়।
জন্মচিন্তার বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলি দুটি রাস্তা ধরে এগিয়ে ছিল। একটিতে ছিল মানুষের বা মনুষ্য জাতির উদ্ভবের উৎস অন্যটিতে ছিল বিকশিত মানুষের বিকাশের কথা। একটিতে ইতিহাস, অন্যটিতে জন্মকথা, যেটা খুলতে খুলতে এখন আমরা ডিএন এ পর্যন্ত চলে গেছি। এখন আমরা মনুষ্য জাতির উদ্ভব থেকে বর্ণ বিভিন্নতার শাখা প্রশাখা শিরা উপশিরা সবকিছুই দেখতে পারি ডিএন এর মানচিত্র থেকে।
ডারউইনের আঙুল ধরে ধরে আমরা অনেক এগিয়ে গেলাম প্লাইসটোসিন, ইয়োসিন, ক্রিটেসিয়াস ধরে ধরে কেমব্রিয়ান মুখে এসে দেখি অতি বিকশিত জীব এই মানুষের দেখা আমরা পাচ্ছি মাত্র দেড় দুলাখ বছর ধরে দুপেয়ে মানুষ। দুপায়ে দাঁড়ানো মানুষের মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতেও লেগেছিল আরও পঞ্চাশ হাজার বছর। যেখানে পৃথিবীর অস্তিত্ব আমরা খুঁজে পাচ্ছি ৪৫০ কোটি বছর থেকে। কাজেই পৃথিবীতে মানবজন্ম এখনো তার শৈশব অবস্থায়। এর পেছনের ইতিহাসে জীব অনেক জটিল জীবন অতিক্রম করে এসেছে মানুষের জন্ম নিতে। এই জীবজগতের ইতিহাসকে ডারউইন একটা ধারায় বেঁধে দেখিয়েছেন যে বিগত ১১০০ বছরের পৃথিবীর এই বিশাল, জটিল জীবসম্পদ, যা বিশ্বের অন্যতম বিবিধতায় ভরা ঐশ্বর্যও বটে, এটি শতেক কোটি বছর আগে আরম্ভ হয়েছিল জীবের সরলতম অবস্থা থেকে। আরম্ভে শুধু এ্যামিবাই ছিল জীব বলতে।
গাছপালারা এসেছে আগে। মেরুদণ্ডী প্রাণীরা আসতে আসতে লক্ষ লক্ষ বছর আরো পেরিয়ে গেছে।
কি ভাবে হোল? পৃথিবীর কি কোন শেষের দিন আছে? উত্তর খুঁজতে খুঁজতে প্রলয়ের কথা, ক্ষয়ক্ষতির কথা চলতেই থাকবে। তখন দেখব কোন প্রলয়ই এত বড় হতে পারে না রে গোটা এই পৃথিবীকে ই গ্রাস করে নেবে। তবে গ্রহ নক্ষত্র দের হেরফেরে পৃথিবী কোনদিন নিশ্চিহ্ণ হতে পারে। তথাপিও পৃথিবীর বস্তু বা mass এর বিনাশ হবে না। সেটির বিলয় হবে ব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোন বস্তুতে।
এবার আমরা এই আরম্ভ আর শেষ এর আধ্যাত্মিক ও নান্দনিক দিকটিকে দেখি। এই বিষয়টি সর্বাধিক বিকশিত হয়েছে ধর্ম নামক প্রতিষ্ঠান টির ছত্রছায়ায়। এর আরম্ভের ধারণাগুলি যখন গড়েছিল সে সময় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গুলি গড়ে ওঠেনি। কিন্তু সমাজ ছিল। ভিন্ন ভিন্ন মহাদেশের অতি গহনে বিকশিত এই সমাজগুলিতে একত্রিত বাস করার নিয়মাবলী বিকশিত হওয়ার পাশাপাশি অনেক অজানা বিষয়কে জানার আগ্রহ জন্ম নিচ্ছিল। এর ভেতরে প্রাচীন তম চিন্তা গুলি ছিল মিশর (ইজিপ্ট) ও ভারতের। এ বিষয়ে একমাত্র ভারতেরই পুঁথিগত প্রমাণগুলি সর্বপ্রাচীন। ঋগ্বেদ গ্রন্থটি সংকলিত হয়েছিল আজ থেকে পাঁচ হাজারের বছরেরও আগে। এতে জন্ম ও মৃত্যু এই দুই তত্বেরই ওপর অনেক আলোচনা, মতামত, নিষ্কর্ষ রয়েছে। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে আমরা জন্ম ও মৃত্যু দুটিরই অকাট্য নিষ্কর্ষ পাই।
এবার আমরা মৃত্যু সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণাবোধ গুলি কে দেখতে পারি বিভিন্ন ধর্মে মৃত্যু সম্পর্কে আস্থাবান দের কি ধারণা?
বুদ্ধ কল্পনা করেছেন এক নিরন্তর জীবনের যা কালের পর কাল ডিঙিয়ে আবির্ভাব হয়ে আসে। এখানে এটা আসে একটাই সীমিত ভূখণ্ডে।
মানুষের আয়ুষ্কাল এতোই সংক্ষিপ্ত যে এক জীবনে মানবীয় সব সংকল্প সকল করণীয়দের সমাপন হয় না তাই বুদ্ধ বার বার জন্ম নিয়েছেন পৃথিবীতে। এই ভারতভূমিতেই। এই নিয়েই জাতকের গল্প। বুদ্ধ, যিনি জ্ঞানী, সদাচারী, সুবিচারক, তাঁর কর্ম ও সমতাবোধের দায়কে সম্পূর্ণ ভাবে সমাপন করার জন্য তাঁর একটাই জন্মের পুণরাবৃত্তি ঘটিয়েছেন বারবার। বলাই বাহুল্য, জাতকের জন্ম, মৃত্যু ও তারই পুনরাবর্তন এই ধারণাটি সনাতন (হিন্দু) আস্থা থেকেই নেওয়া। ইসলামএ মৃত্যু কল্পনাটি অরিজিনাল নয়। তারা মারা গেলে আল্লাহর কাছে সারা জীবনের সুকর্ম দুষ্কর্মের হিসাব পেশ করে যাতে আল্লাহ নির্ণয় নিতে পারেন কে বেহেস্তে (স্বর্গে) যাবে কে যাবে দোজখ এ। খ্রীস্টান ধর্মে মারা যাওয়ার পর কি হবে তার স্পষ্ট খোলাসা নেই। ঈশ্বর পাঠান আবার ঈশ্বরই ডেকে নেন।
হিন্দুদের অনেক ভাবনা- ধারণা গড়ে উঠেছে এ বিষয়ে। প্রাথমিক ধারণা টি ছিল আত্মা ও দেহকে নিয়ে।
আত্মা ও দেহ মিলিয়ে মানুষ যে দিনে দিনে গড়ে ওঠে। মৃত্যু হলে আত্মা দেহ ছেড়ে চলে যায় এবং মৃত্যুর পর মরদেহকে পুড়িয়ে নষ্ট করা হয় ও দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যায়। আত্মার বিলয় হয় না। আত্মার ধারণাটি আইনস্টাইনের mass-energy consortium এর সঙ্গে তুলনীয়। সেইরকমই দেহর পঞ্চভূতে বিলীন হওয়াটি কেমেস্ট্রির conservation of matter এর সঙ্গে মেলে।
উপনিষদে যম নচিকেতা সংবাদ এ যম খুব বিস্তারিত ভাবে বলেছেন চিতা সাজানোর কথা রাতে দেহটি পুড়ে ছাই হয়ে যেতে পারে অনুকূল হাওয়ায়
কিন্তু পরবর্তী প্রশ্নের উত্তরে যম নচিকেতা কে জানাচ্ছেন মে মৃত্যুর পর মানুষ কোথায় যায় তা তিনি জানেন না।
এখানে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে যম-নচিকেতা সংবাদ এর যম কোন দেবতা নন। তিনি জীবনের শেষ অধ্যায়ে শরীরের বিনশ্বরতার বৈজ্ঞানিক উপসংহারের বিষয় টি জানেন কিন্তু জীবের অবিনশ্বর উপাদানটির (আত্মার) পরিণতি সম্পর্কে কিছুই জানেন না।
ডেনমার্কের একটি গল্প লিটল মারমেইড তাতে আছে ছোট্ট এক জলপরীর কথা, হান্স আণ্ডারসনের লেখা। এই ছোট্ট জলকন্যা তার নীচের শরীরে পা নেই, মাছের লেজের অংশ দিয়ে গড়া। জলকন্যা জাহাজে ভ্রমণরত এক পরমসুন্দর রাজকুমারকে দেখে ও তার প্রেমে পড়ে যায়, রাজকুমারকে পেতে চায়।এই প্রেমকথায় জলপরীর পায়ের জায়গায় সাঁতারু মাছের শরীর থাকাটা একটা প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়ায়। মাছের দেহের তলায় তার সুন্দর, দীঘল দুটি পা ছিল। এবার জলপরী মানুষ হতে চাইলে সর্ত ছিল যে রাজকুমারও যদি তাকে ভালবাসে তাহলে কিছু সমস্যা থাকে না
কিন্তু এই ভালবাসা যদি না থাকে তাহলে জলকন্যা আর জলে ফিরে যেতে পারবে না।
তার শরীর ঢেওয়ে ভেঙে ভেঙে সৈকতে আছড়াবে ও সমুদ্রের ফেনা হয়ে বিলীন হয়ে যাবে।
এই বিলীন হয়ে যাওয়ায় আমরা শরীর ও আত্মার অন্তিম অবস্থা দেখতে পাচ্ছি সমুদ্রের ঢেউ আছড়ানোর থেকে উদ্ভূত ফেণা য়। গল্পটি রূপকথা ও বর্ণনা টি কাব্যিক। অতএব আমরা শরীর ও আত্মার মহাজাগতিক শূণ্যে বিলীন হয়ে যাওয়ার এই তত্ত্ব টুকু কেও আপন ধারণা বোধে এনে নিতে পারি। কল্পনা চাওলা হয়ত এইভাবেই মিলিয়ে গেছিলেন মহাশূন্যে।
আমেন।
Post a Comment