DEHLIJ

শুভদীপ মৈত্র

 ।। সঙ্গ নিরুদ্ধের ফিসফিসানি।।





ধর্ম যদি আফিম হয় মানুষের তো কবিতা মদ। মাঝে মাঝে পান করলে মনে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, নিয়মিত পরিমিত পরিমিত পানে স্বাস্থ্য ফেরে আর অতিরেকে বমি। আমাদের যাতায়াত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ওই প্রথম থেকে তৃতীয় স্তরে। পরিমিতি-হীন রসাস্বাদন বিষ বটে। 


পাশের বাড়ির ছাদে একটা লোহার জাল ধরনের বসানো – প্রথম যখন এ ফ্ল্যাটে আসি বুঝিনি – পায়রা বসার জন্য। এখনো হরেক কিসিমের পায়রা এসে বসে, আজ সকালে বন্ধু পানকৌড়ির সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়ে দেখি একজন দুধ-শাদা শান্তির দূত-সম দেখতে পায়রা মশাই সেখানে বসে আছেন। গর্বের সঙ্গে। কারণ সঙ্গিনীও রয়েছেন এক, ধুসর গাত্রবর্ণের। এই দৃশ্য সুন্দর। এই দৃশ্য মনুষ্য-সৃষ্ট। অন্তত বলা যায় মানুষের অনেকটা হাত রয়েছে। তাহলে এই যে হঠাৎ শুনছি প্রকৃতিই একমাত্র সৌন্দর্য সৃষ্টি করে এবং মানুষের সবকিছুই কুৎসিত – এতটা একদেশদর্শীতার প্রয়োজন নেই, মানুষ তার চরম মুহূর্তে অসামান্য এক সৌন্দর্য্য-স্রষ্টা এবং তার অতি নিম্নতম অবস্থাতেও তার ছিটেফোঁটা রয়ে যায় এই বিশ্বাসে থিতু হতে না পারলেও ঝাপটার মতো, দখিন হাওয়ার মতো মাঝে মধ্যে গায়ে লাগে সে অনুভূতি। যদিও ঠিক ছাদের নিচে জঞ্জালের স্তূপ, তাকালে গা গুলিয়ে ওঠে এবং এটাও তাদেরই অবদান যারা আকাশে ওই পায়রাদের পাখা মেলা সাধ্য করে। এটাও বাস্তব বটে। 


১০

সঙ্গ-নিরোধের শুরুতে পাঁউরুটি পাওয়ার একটা ক্রাইসিস দেখা দিয়েছিল। বাঙালী লুচি-খোর জানতুম এমন পাঁউরুটি-খোর জানা ছিল না। অবশ্য ছোটবেলায় ডেলি-প্যাসেঞ্জারি-কালে দেখেছি গরিব মানুষ ফটাস জলে পাঁউরুটি ডুবিয়ে খিদে মেটাচ্ছে। হকার চিল্লাত ট্রেনের ভিতর – রুটি-নাটি, রুটি-নাটি। নাটি অর্থাৎ লাঠি অর্থাৎ ক্রিম রোল। আর রুটি হল লোফ। ছোটবেলায় পাঁউরুটি মানে জানতাম পা দিয়ে তৈরি রুটি। শ্রমিকেরা পা দিয়ে ময়দা ডলেন নাকি কারখানায় তাই ওই নাম। তারপর কে একজন দাদা কাকা গোছের জানাল আরে দূর দূর পাউন্ড মানে ওই ওজনের হিসেবে বিক্রি হয় বলে পাউন্ড-রুটি। তার থেকে পাঁউরুটি। তাই সই। তারপর এগারো বারো ক্লাস নাগাদ জানা গেল পাঁ বা পঁ ফরাসি বা পর্তুগিজে ব্রেড বা রুটি। তবু কী মনের মধ্যে থেকে আগের ছবিগুলো মিলিয়ে গেছে – কই না তো? কবিতার মধ্যেও শব্দরা এইভাবে বসে থাকে নানা মানে নিয়ে নানা ছবি নিয়ে – তা শুধুমাত্র যে পড়ছে তার সত্যি, আর কারো না। 


১১

সমগ্রের দুঃখের সামনে ব্যক্তিগত দুঃখ কিছুই না। অথচ সেই ব্যক্তিগত দুঃখগুলোকে কবিতায় ধরে রাখা এক সময় রীতি ছিল। এই-যে আমি সঙ্গ-নিরোধে ছটফট করছি, আমার সামান্য যা কিছু প্রিয় – শহরের আনাচ কানাচ, কয়েকটা কাফিখানা আর রেস্তোরাঁ, চা বা বিয়ার নিয়ে দুপুরে কোনো এক মেয়ের সঙ্গে কূজনে বিশ্রম্ভালাপে কাটানো নিভৃতি। বিশাল মন্বন্তরে দাঁড়িয়ে এ সামান্য দুঃখ – তবু সেই সামান্য দুঃখের কথাগুলো এলিজিয়াক। সময়কে ধরে ফেলতে পারে। সমগ্রকে সেই দুঃখের ছোট বালির কণায় ধরা যেতে পারে যেভাবে মরুভূমি। কবিতা ওইভাবেই ছোট ছোট ফুলের চয়নে মালা হোক। 


১২

বিশাল আমাদের কল্পনার বাইরেই থেকে যায়। আমরা যারা আধুনিক নাগরিক। এই ঝড়ের তাণ্ডব পিঁপড়ের মতো দেখলাম। সারাদিন এত বড়ো ঝড়, এই তার রুদ্রমূর্তি, আমি তার মাঝে জানলার কপাট, ছিটকিনি পরীক্ষা করতে করতে কাটালাম। বাইরে হাওয়ার গর্জন যেন অক্ষহিনী সেনা একের পর এক চলেছে। আর আমি কাঁচের বয়ামে রাখা গাছকে নিরাপদ রাকার চেষ্টা করছি, মোম-দানে মোমবাতিটা ঠিক করে বসছে না দেখছি। বাইরে গাছ পড়ে গেল, ছাদ উড়ে গেল – পুকুরে যে টিনের বেড়া তা হাওয়ার দাপটে আধখানার উপর ভেঙে নানা ভঙ্গিমায় বেঁকে চুড়ে ব্যালে নাচছে। আর ওই অ্যাসবেস্টারের চালগুলোয়, দেওয়ালে, কার্নিশে গাছের ডালে যে আওয়াজ তাকে কী বলব তাকে! ডেথ মেটাল! আর তখন আমার জানলাগুলোই যেন পর্দা যা সরিয়ে খানিকটা দেখে আমি আবার চলে আসছি ঘরের ভিতর। সঙ্গ-নিরোধ সেই মুহূর্তে যেন দুর্গ, যেন আমি আজন্ম এভাবেই। একেই লালন করেছি মাথার ভিতর, অস্তিত্বের সঙ্গে, যেন শরীরের একটা অংশ হয়ে উঠেছে – আশ্চর্য আমি কি কখনো ঝড়ের খেয়া পড়েছি? শুনেছি? আসলে আমি সঙ্গ-নিরুদ্ধ নই, বুঝে ফেলি আমিই মূর্ত সঙ্গ-নিরোধ। 


১৩

রক্তে তবু আদিমতা রয়ে গেছে। এমন ঝড়ের রাতে পুরুষ পাগলের মতো আগলায় তার ঘর-দোর, গরু-মোষ, যাবতীয় যা সে সম্পত্তি বলে জানে। আর নারী। এমন দিনে এরা চলে যায় ঝড়ের সাথে অথবা পরের সাথে। বাইরে তখন হাওয়ার  দাপটে কেঁপে কেঁপে উঠছে বাড়িটা। আমি এ-ঘর ও-ঘর করি। আদিম কোনো সম্পদ আমার নেই তবু আগলানো। তাই ছিটকিনি লাগাই, দড়ি-দড়া দিয়ে জানলার কপাট খুলি আর বাঁধি। আদরিনী খাটে শুয়ে থাকে আধবোঁজা চোখে। যেন সে ঝড়কে পড়ে ফেলেছে কোনো কবিতার বইয়ের মতোই দু-চার পাতা, তারপর বাকিটা অবহেলায় সরিয়ে রেখেছে। অথবা সেঁধিয়ে গেছে কবিতার ভিতরে। অথবা ঝড়ের। সে খবর পুরুষের কাছে পৌঁছয় না কখনো। প্রেমিকের কাছেও পৌঁছয় কি? এমন ঝড়ের রাতে নারী কি চায়?


১৪

পাড়ার রাস্তা দিয়ে ষাট ছুঁই ছুঁই এক ভদ্রলোক যাচ্ছেন দেখলাম, টেরিকটের ট্রাউজার, শার্ট যা বহু ব্যবহারে ম্যাড়মেড়ে, হাতে দু-দুখান বাজারের থলে, খানিক হাঁপাতে হাঁপাতে দুলকি চালে চলেছেন বড়ো রাস্তার দিকে। রোজের মতোই। দেখে বোঝার উপায় নেই বারো ঘণ্টাও কাটেনি শহরের উপর দিয়ে যে ঝড়ের তাণ্ডব চলেছে তা আদৌ ঘটেছে কি না! বাজারের থলি তবু সত্য। নির্বোধ অথবা কবিই একমাত্র এমন নিস্পৃহ হতে পারে। 


১৫

প্রতি মুহূর্ত যখন পরের মুহূর্তের টিঁকে থাকার অনিশ্চয়তায় কাটে তখন টিঁকে থাকাটাই একমাত্র কবিতা। 


১৬

কী অদ্ভুত নীল আকাশ, পেঁজা পেঁজা শাদা মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে – ঝড়ের চিহ্নমাত্রটুকু নেই আর। সময় আর আকাশের গায়ে দাগ পড়ে না। সুন্দর স্মৃতিহীন একটা অনন্ত মুচকি হাসি। 


১৭

সুখের পায়রা শব্দটার মানে আমি জানি না। তবে পায়রাগুলো ফিরে এসেছে নিজস্ব খোপগুলোতে। শালিক, চড়াইও। একটা কাক উলটে-পড়া ফুলের টবে ঘাড়ে মাথা গুঁজে যেভাবে শুয়েছিল ভাবলাম মরে গেছে। একটা বেড়াল গুটিগুটি এগোতেই চেঁচিয়ে উঠল। খন্ডহরেও কেউ কেউ ফিরে আসে। বিজলী বাতিতে অভ্যস্ত চোখ যেমন তার অভাবে বুঝে নিচ্ছে মিটিমিটি তারার আলো।



No comments

FACEBOOK COMMENT