শৌভ চট্টোপাধ্যায়
ধ্বংসের দিকে ফেরানো একটি মুখ
১
কাকেই বা জেগে ওঠা বলে?
এই যে এখন তুমি আড়মোড়া ভেঙে, মুখের মধ্যে আবিষ্কার করছ একটা বিশ্রী তিতকুটে স্বাদ, আর তোমার মনে হচ্ছে, গতরাতে ঘটে-যাওয়া সেইসব আশ্চর্য ঘটনা, একটা কিমাকার ছায়ার সঙ্গে তোমার যাবতীয় কথোপকথন, আসলে এক অলীক স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়—একেই কি তুমি জেগে-ওঠা বলবে?
কেন নয়? বাধকপ্রত্যয় বলেও তো একটা ব্যাপার আছে! হাতের সামনে, এই যে জলের গেলাস, ঘড়ি, আমার চশমা আর পেন—যাদের আমি ছুঁয়ে দেখতে পারছি, ইচ্ছামতো নাড়াচাড়া করছি, এদের বাস্তবতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করবে কোন আহাম্মক? আর এর উল্টোদিকে, ভাবো, সেই ছায়া-ঢাকা রাত্রির মিনার, বিচিত্র মানুষজন, তাদের দুর্বোধ্য কথা, সমুদ্রের ভাষাহীন চিৎকারের ওপর ঝুঁকে থাকা একটা পাথুরে আকাশ—এরা যে নিছকই মরীচিকা, একটা জটিল বিভ্রমমাত্র, এ-কথা কি দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট নয়? দিনের আলোয়, দেখ’, কীভাবে মিলিয়ে যাচ্ছে গলার কাছে দলা-পাকিয়ে ওঠা অনিশ্চয়তা, আর অবান্তর এইসব ছবি...
দিনের আলো? কোথায় দিনের আলো? তুমি কথা বলছ কার সঙ্গে?
আমি কথা বলছি? কার সঙ্গে?
২
কার সঙ্গে কথা বলছি?
ধীরে ধীরে, এক জটিল
বাক্যের মতো সেজে উঠছে সকাল।
আর সেই নীল শার্ট
যার কোনো শরীর নেই, সামান্য বাতাসে
সে-ও আরেকবার ছটফট করে উঠল।
কার জন্য? আমি—
‘আমি’ শব্দের মধ্যে, আবিষ্কার করেছি
স্বপ্নহীন, একটানা ঘুমের রহস্য,
আর এক আশ্চর্য না-থাকা।
‘আমি’ দিয়ে যেসব বাক্য শুরু হয়,
তাদের শেষে, যতিচিহ্ন দেওয়ার সময়ে
তোমার হাত বারবার কেঁপে যায়।
আমি লক্ষ করেছি...
৩
এবং আমি লক্ষ করেছিলাম, কীভাবে
আলো-ছায়ার এই জটিল বিন্যাস থেকে
ক্রমশ ফুটে উঠছে একটা অবয়ব,
কীভাবে মানুষের ছায়া থেকেই
মাথা তুলছে আরেকটা মানুষ।
মিথ্যে বলব না, আমি ভয় পেয়েছিলাম। ফাউস্টের মতো, অ্যালকেমি কিংবা যাদুটোনার কোনো পূর্ব-প্রস্তুতি আমার ছিল না। এমনকী, ভার্জিলও পড়িনি, যে তাঁকে অনুরোধ করব আমার পথপ্রদর্শক হতে। ফলে,
আমার বিশ্বাস ছিল ভঙ্গুর, আর অবিশ্বাসও
অস্থির, ফাঁকা
পরিত্যক্ত এরোড্রোম-জুড়ে, তখন
আমি পরিষ্কার শুনতে পেয়েছিলাম,
লক্ষ লক্ষ অদৃশ্য পাখার গুঞ্জন, এবং
ত্রস্ত এক বালিকার ছুটে-যাওয়া
পায়ের আওয়াজ!
আপনাকে দেখেছিলাম—অন্ধকারে, আমার দিকে ঝুঁকে, হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, করমর্দনের ভঙ্গিমায়। মিথ্যে বলব না, আমি ভয় পেয়েছিলাম।
৪
আমি ভয় পেয়েছিলাম।
আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে,
আমার মনে হয়েছিল—জল ঢুকছে
নৌকোর ভাঙা গলুই দিয়ে,
কালো, ঠাণ্ডা, রাত্রির অন্ধকার জলে
ভরে উঠছে নৌকোর খোল।
হাওয়ায় কেঁপে-কেঁপে উঠছে চরাচর, দূরে
সরলবর্গীয় বৃক্ষের সারি, আকাশের গায়ে
এক যন্ত্রণাকাতর অরণ্যের ছায়া।
আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে,
আমার মনে হয়েছিল—হা-ক্লান্ত আপনি
হয়তো জিরিয়ে নিচ্ছেন, বসে
এক প্রকাণ্ড ধ্বংসস্তূপের ছায়ায়।
সম্পাদকের চোখে এই সংখ্যার অন্যতম সেরা লেখা
ReplyDelete