DEHLIJ

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

 লকড়ি কি কাঠিঃ ছড়া-ছবির ভুবন 



'আসলে কেউ বড়ো হয়না, বড়োর মত দেখায়'। শক্তি চাটুয্যে কবেই বলে গেছেন। সত্যিই ত'। কেই বা বড়ো হয়! বাস্তবে 'নকলে আর আসলে তাকে, বড়োর মত দেখায়'। শিশুটি তখন আসল-নকলের মেকি যুদ্ধে অংশ না নিয়ে চুপটি করে ঘাপটি মেরে থাকে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে শরীরের বয়েস বাড়ে। মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকে যে শিশুটি, তার বয়েস বাড়ে কই? সে তক্কেতক্কে থাকে। সময় সুযোগ পেলেই লাফিয়ে বেরিয়ে আসে। মাথা ঝাঁকায়, দামাল-দস্যিপনায় মাতে। এই শৈশব, এই সারল্য চিরকালীন। প্রত্যেক বছর শিশু দিবস আমায় এই কথাই শেখায়। আর শেখায় 'ঘঞ্চু'। তার অবিরাম দস্যিপনা, দুষ্টুমি আর তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী হরেক রকম ছড়া আর গান দিয়ে।
ছোটবেলায় 'ছেলেভুলানো' ছড়া আর গান কে না শুনেছে। তখন আমাদের মা, মাসি, ঠাকুমা, দিদিমা বা দাদুরা ছিল আমাদের পৃথিবী। কি অদ্ভুত স্বপ্নের মত সেই সব দিন। যেন জীবনে গান ও ছড়া ছাড়া আর কিছু নেই। 'ঘঞ্চু'র সাথেই পাল্লা দিয়ে ছুটতে গিয়ে আবারও সেই 'ফেলে আসা দিনগুলো'-তে ফিরে ফিরে যাওয়া। আমাদের সময়ে মাসি, দিদা, ঠাকুমারা দুলে দুলে ছোটবেলায় সে'সব ছড়া, গান গেয়ে শোনাতেন। 'ঘঞ্চু'দের ঠাকুমা, দিদিমারাও শোনান বইকি। তবে তারা এখন হেব্বি 'মোবাইল' চালাতে শিখেছে। কি করে শিখলো খোদা-ই জানে।  তবে তার দৌলতে আবারও বেশ কিছু পুরনো ছড়া আর গান শুনে ফেললুম। জয় বাবা ইউটিউবেশ্বর!
'ঘঞ্চু' এখন নিজেই মোবাইল চালায়। পুরোদমে। আড়াই বছরও হয়নি ছোকরার, বাপ রে, সে কি ডেডিকেশন! কথায় কথায় তারস্বরে তার চিল্লানি - 'মাম্মাম...নানি তি! নানি তি!' আমি ভাবি, সেটা আবার কি? ওহ হরি! এত দেখি সেই 'নানি তেরি মোড়নি কো মোর লে গয়ি' ... বিখ্যাত সেই ছড়ার গান। ১৯৬০ সালের অশোক কুমার, হানি ইরানির 'মাসুম' ছায়াছবির গান। রবীন ব্যানার্জির সুরে, শৈলেন্দ্রের কথায় গান গেয়েছিলেন হেমন্ত-কন্যা রাণু মুখার্জি। কালজয়ী গান। এক নিমেষে ফিরে যাই নিজের ছোটবেলায়। মা শোনাচ্ছে 'হাট্টিমা টিম টিম তারা মাঠে পাড়ে ডিম'। কি কাণ্ড, দেখি 'ঘঞ্চু'ও তাই শুনছে। আর তালে তালে তার সেকি হাসি। ততক্ষণে বাঁধ ভেঙে গেছে। জলের তোড়ে বেরিয়ে আসছে - 'আয় আয় চাঁদ মামা টি দিয়ে যা', 'খোকা যাবে মাছ ধরতে ক্ষীরনদীর কুলে', 'ইকির মিকির চাম চিকির', 'বাবুরাম সাপুরে', 'খোকা যাবে শ্বশুরবাড়ি সঙ্গে যাবে কে' অথবা 'আম পাতা জোড়া জোড়া', 'আয় রে পাখী ল্যাজ ঝোলা', 'কাঠবিড়ালি কাঠবিড়ালি পেয়ারা তুমি খাও', 'তাঁতির বাড়ি ব্যাঙের বাসা' আর কত কি! এই লিস্টির শেষ কোথায় জানা নেই। আমাদের সকলেরই ছোটবেলা জুড়ে রয়েছে এইসব ছড়া বা ছড়ার গান। আহা, দিনের শেষেও ত' সেই অদ্ভুত সুরে গাওয়া - 'ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি মোদের বাড়ি এসো' বা 'খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো'র মত কত গান। কে বা কারা লিখেছেন, কারাই বা দিয়েছেন এমন মনকাড়া সুর...আজও অজানা।
'ঘঞ্চু' অবিশ্যি মহা ওস্তাদ। তিনি শুধু বাংলা ছড়া বা গানে আটকে থাকবেন, ইয়ে বহুত না ইন্সাফি! তাই দম ফেলতে না ফেলতে চ্যানেল চেঞ্জ। হইহই করে ঢুকে পড়ে হিন্দি বলয়। 'ঘঞ্চু' বাংলা ছড়ার পালা শেষ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে অ-বাঙালি রাজ্যে। উঠে আসে তার পছন্দের 'দাদি আম্মা দাদি আম্মা মান যাও'। আবার আমার 'ফ্ল্যাশব্যাক'। ষাটের দশকে 'ঘরানা' ছায়াছবির বাচ্চাদের সেই বিখ্যাত  গান, যা গেয়েছিলেন আশা ভোঁসলে। রাজেন্দ্র কুমার ও আশা পারেখের অনবদ্য অভিনয়। রবির সঙ্গীত ও শাকিল বদাউনির কলম। এরপর একে একে উঠে আসে 'বুটপালিশ' মুভির 'ননহে মুন্নে বাচ্চে তেরে মুট্টি মে কেয়া হ্যায়', 'জাগৃতি'র সেই 'আও বাচ্চো তুমহে শিখায়' বা গুলজারের 'মাসুম' সিনেমার বিখ্যাত সেই ছড়ার গান - 'লকড়ি কি কাঠি / কাঠি পে ঘোড়া।' রাহুল দেব বর্মনের সুরে গুলজারের লেখায় গলা মিলিয়েছিল তিন কন্যা - গৌরী বাপট, গুরপ্রীত কউর ও বনিতা মিশ্রা। এই তিন কন্যা পরবর্তী কালে কোথায় যে হারিয়ে গেল, দুর্ভাগ্যের বিষয় তা কেউ জানেনা। শুধু গান'টি রয়ে গেছে আজও দশকের পর দশক, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। অবাক হয়ে দেখি, 'ঘঞ্চু'ও মুখ দিয়ে 'গিগি' আওয়াজ করে মহানন্দে মাথা দোলাচ্ছে। শুধু ক্লাসিকস নয়, 'ঘঞ্চু'র পছন্দের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে বেশ কিছু নতুন ছড়াও, নিত্য নতুন সুরে। সেখানে রয়েছে - 'দো চুহে থে / মোটে মোটে থে', 'হাতি রাজা কিধার যাও' বা 'আহা টমাটর বড়ে মজেদার', 'চান্দা মামা দূর কে'- র মত বেজায় মজার সব ছড়ার গান। সেই তালিকা'ও সহজে কিন্তু ফুরোবার নয়। নাহ, সে অর্থে 'ঘঞ্চু' এখনো ব্রিটিশ হয়ে ওঠেনি। 'ইঞ্জিরি' মানে 'ইংরাজি' ছড়া এখনও তেমন রপ্ত হয়নি তার। 'জ্যাক এণ্ড জিল', 'টুইঙ্কল টুইঙ্গল লিটল স্টার'-ই তার দয়া-দাক্ষিন্য পেয়েছে। ভবিষ্যতে কি হবে কিছুই বলা যায় না।
আশ্চর্য, আমিও দেখছি 'ঘঞ্চু'র তালে তালে মাথা দোলাচ্ছি। মাথার মধ্যে নীরবে হয়ে যাচ্ছে একের পর এক ছড়া ও গানের 'কেমিক্যাল লোচা'। অন্য দিকে মন ঘুরলেই 'গুনগুন' করে গাইছি সেই সব গান...সেই সব ভুলে যাওয়া সুর। নিজের খেয়ালে। কোথাও না কোথাও 'ঘঞ্চু' হাত ধরে উঠে আসছে আমারও শৈশব, ফেলে আসা অতীত। একধাক্কায় পিছিয়ে যাচ্ছে সময়, আবারও তা আসছে এগিয়ে।  আমি অবাক হয়ে দেখি, 'ঘঞ্চু' তার ফোকলা দাঁত বের করে বাবার কাণ্ড দেখে হাসছে। আধো-আধো গলায় বলছে - 'বাবা ওতো!' আমি দেখি, আমার জন্য অপেক্ষা না করে, সেইই আমায় দু'হাত ধরে তুলছে টেনে। আমিও তার হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছি - আমার শৈশবের দিকে, একটু একটু করে। ভুলে যাওয়া ছোটবেলার গান আর ছড়ার সুরে ভেসে। 


হবে নাই বা কেন শুনি! গোলাম মোস্তাফা সেই যে কবে বলে গেছিলেন - 'ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে'। কবিরা ভবিষ্যতদ্রষ্টা। তাদের কথার নড়চড় হয় না যে! 'ঘঞ্চু'রা দীর্ঘজীবী হোক।

1 comment:

  1. কি নষ্টালজিক লেখা!
    সুনেত্রা সাধু

    ReplyDelete

FACEBOOK COMMENT