DEHLIJ

তমাল রায়

লিটল ম্যাগাজিন ও  তমাল রায়ঃ একটি কথোপকথন




 বাংলা সাহিত্যের জন্য নেপথ্যে থাকা যে সকল মানুষ নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, দেহলিজ বরাবরই চেয়েছে সেইসব মানুষের কথা আলোচনা করতে, চর্চা করতে।এরকম একটা অবস্থান থেকে আজ দেহলিজের সাথে রয়েছেন লেখক ও ঐহিক পত্রিকার সম্পাদক তমাল রায়।

তমালদা, তোমায় দেহলিজের সংগে কথোপকথনের জন্য অনেক ধন্যবাদ, আর অনেক ভালোবাসা তো রইলো বটেই।

## দেহলিজের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ। পীযূষ আর রাহুল তোমাকেও।

1. তমালদা, আমার প্রথম প্রশ্ন : তোমাদের ৯০তে তো লিটিল ম্যাগাজিন অনেক ছিলো।নতুন একটা পত্রিকার চিন্তা কিভাবে এলো?সাথে ব্যক্তি তমাল রায়ের লেখালিখি থেকে পত্রিকা সম্পাদনায় আসা; এই জায়গাটা দিয়ে যদি শুরু করো

## ব্যক্তি তমাল রায়ের লেখালিখির শুরু ১৯৮৫ সাল থেকেই। বরানগরের এক স্থানীয় লিটল ম্যাগ সাহিত্য সংহিতায় লিখতে শুরু করি ১৯৮৫তেই। সম্পাদক মৃদুল শ্রীমানী আমার প্রিয় অগ্রজ। সম্পাদনা করতেন তিনি। শুরু নিবন্ধ দিয়ে। বিদ্যাসাগর,ক্ষুদিরাম,প্রফুল্ল চন্দ্র রায় আবার জাতীয় অর্থনীতি নিয়েও। পরে গল্প লিখতেও শুরু করি। গল্প অনেকেই পছন্দ করতেও শুরু করে। সেখানে নিয়মিত সাহিত্য সভাও হত। পরিচিতি বাড়তে শুরু করে। এর জন্য মৃদুলদার কাছে আমার আজন্ম কৃতজ্ঞতা। কিন্তু একটা সমস্যার সম্মুখীন হই। সেটা ঠিক পত্রিকাটির সমস্যা বলবো না,কর্ণধারদের অধিকাংশই একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলো। ফলতঃ স্থানীয় অঞ্চলে আমরা ট্যাগড্ হয়ে যাচ্ছিলাম,ওই রাজনৈতিক দলের কর্মী হিসেবেই। যা আমরা প্রকৃতপক্ষে ছিলাম না। শুধুমাত্র লিখতে গিয়েই সংঘবদ্ধ হওয়া। যেহেতু সেই রাজনৈতিক দলটি বামমনস্ক অথচ তদকালীন রাজ্য প্রশাসনের বিরোধী হিসেবে পরিচিত। তাই,সরকারি দলের আঞ্চলিক আমচা চামচাদের বুলির শিকার হতাম অকারণেই! এবং পত্রিকাটির নিয়ম নীতির সাথে আমাদের মিলছিলো না। ফলতঃ আমরা বেরিয়ে আসি। নিজেদের একটা প্ল্যাটফর্ম জরুরি মনে হয়। শুরু করি ঐহিক। শুরুটা কিন্তু ১৯৯০ নয়। আরও আগে,১৯৮৮তে। প্রথম দেওয়াল পত্রিকা। পরিচিতি তৈরি হতে শুরু হয়,তারপর সাইক্লোস্টাইল,তারপর ছাপা পত্রিকা। ছাপা পত্রিকা হিসেবে প্রথম প্রকাশ পেলো ১৯৯০এর অক্টোবরে,পুজোর সময়।

2.    ঐহিকের প্রথম দিককার একেবারে শুরুর দিকের চ্যালেঞ্জ নিয়ে, কিছু কথা যদি আমাদের সাথে শেয়ার করো।কতজন লেখক নিয়ে শুরু হয়েছিলো ঐহিক?

## জন্মের সময় তো আনন্দের হয়। সেই মনুষ্য সন্তান বা পত্রিকা। যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল,তাকে ঘিরে তো আদিখ্যেতার বহর থাকে। সেটাই ন্যায্য। কারণ তাকে স্বাগত জানানো হচ্ছে এই দুনিয়ায়। পত্রিকাও তো ১৯৯০ তে শিশু। তাকে ঘিরে প্রবল উন্মাদনা। উৎসাহী পিতা মাতার দল,কম্যুনিস্ট পার্টির মত পুজোয় রোড সাইড স্টল খুলে বসি। এবং বিক্রি প্রচূর। বিক্রি পত্রিকার একমাত্র মানদণ্ড নয়। তবে অন্যতম নির্ণায়ক তো বটেই। প্রথম সংখ্যা ছাপা হয়েছিল ১৩০০ কপি। বিক্রি হয়ে যায় ১২৫০ কপি শুধু দুর্গাপুজোর স্টলেই। ফলে শুরুতে চ্যালেঞ্জ ছিলো না। তারুণ্যে টগবগে একটা পত্রিকা। অনুষ্ঠান করছি সাহিত্য ও সংস্কৃতির অল্প দিনেই ঐহিক গোষ্ঠী পরিচিতি ও পাঠক প্রিয়তা পেয়ে যায় আমাদের বরানগর কাশিপুর অঞ্চলে।

3.    কিছু লেখক/কবিদের কথা বলো যাদের সেই সময় সম্ভাবনাময় মনে হয়েছিলো এবং তাঁরা বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের কোথায় দাঁড়িয়ে?

## এবার দুঃখের কথায় আসি। শুরুর সাথী যারা তারা সকলেই যে প্রবল সাহিত্য প্রেমী তা নয়। কেউ সঙ্গীত প্রেমী। কেউ বা বাচিক শিল্পী। কেউ চিত্রকর। সময়ের সাথে তারা সরতে শুরু করে। একদল আসে,একদল যায়। ফলে শুরুর লেখক কবিরা কেউই আজ আর লেখায় নেই। কিছু পরে যারা যুক্ত হন,তাঁরা আজও লেখায় আছেন। যেমন শুভ্র ভট্টাচার্য,অর্ণব ভট্টাচার্য, অগ্নিজিৎ, অনিন্দ্য, প্রসেনজিৎ, বাসব মৈত্র, সোমনাথ ঘোষাল, চিত্রালী ভট্টাচার্য ও রীনা ভৌমিক।
তবে এঁরা বাংলা সাহিত্যের কোথায় দাঁড়িয়ে এ বিচার করা আমার পক্ষে সম্ভবপর নয়। তবে এঁরা সকলেই সাহিত্যচর্চায় অনিয়মিত। অধিকাংশই ক্ষমতাশালী লেখার ক্ষেত্রে। নিয়মিত হলে ভালো লাগত নিজেরও। ব্যতিক্রমও আছে। অর্ণব নিয়মিত তার মত করেই। অগ্নিজিৎ সম্ভাবনাময়। কিন্তু ওই যে বললাম, লেখেনা নিয়মিত। সোমনাথ লেখায় আছে। ভালো লেখে। বাসব মৈত্র হারিয়ে গেছে প্রায়ই,দুঃখ বোধ হয় ওর জন্য।  প্রসেনজিৎ একমাত্র ব্যতিক্রম,যে লেখাকে কেন্দ্র করেই পেশায় নিযুক্ত। গদ্য লেখার শুরুটা ঐহিককে ছুঁয়েই। আজ ওর অন্নসংস্থান হয় লিখে। ভালো লাগে।

4.    লেখা আর সম্পাদনা; দুটোই সমান তালে।কখনো অসুবিধে হয় না?

## সব্যসাচী নই। আর শুধু লেখা বা সম্পাদনাই তো জীবন নয়। কর্মজগৎ পৃথক। সেও এক সমস্যা। এছাড়া পরিবার,নিজের শারীরিক সমস্যা,সব মিলিয়ে অসুবিধে বহুবিধ। ফলে লেখক তমাল  বঞ্চিত হয়েছে বরাবর। এগিয়ে গেছে সম্পাদক, সংগঠক তমাল।

5.    আবহমান কবিতা বা প্যারালাল কবিতা বা কবিতার শ্রেণীবিন্যাসে তুমি কি বিশ্বাস করো? আজ যেভাবে কলকাতার প্রথম সারির পত্রিকা ( উদাহরন, দেশ, কৃত্তিবাস ইত্যাদি) বাংলা কবিতার সংজ্ঞা নির্ধারন করছে , সেই সব লেখকরা কখনো ঐহিক পত্রিকায় লেখেন?

## আমরা এই শ্রেণী বিভাগে তেমন বিশ্বাসী নই। বা লেখাকে কেন্দ্র করে শ্রেণী বৈষম্যে অনুপ্রেরণা, ইন্ধনদাতা হতে চাইনি কখনও। ঐহিক সবার। এভাবেই ভাবতে চেয়েছি। যে প্রবল গালি দিয়েছে তাঁর প্রতি সাময়িক খারাপ লাগা থাকলেও অসূয়া পোষণ করিনি। এ বিষয়ে বারীনদা আমার পথ প্রদর্শক। বারীন ঘোষাল। প্রতিদিন বাবা মার সাথে তাকেও স্মরণ করি। বারীনদা বলতেন,তমাল আমরা যারা লিখি সাহিত্য চর্চা করি,সকলেই আত্মীয়। কাউকে পর ভাববি না। অ-পর।' আমি সেই ভাবনাতেই বিশ্বাসী। আনন্দবাজারের কর্মীও ঐহিকে লেখে। আনন্দবাজার তার পেশা জগৎ। ব্যক্তি মানুষটিকে তো আর আনন্দবাজার কিনে নেয়নি। কৃত্তিবাসীরাও লেখেন। ক্রিয়েটিভ রাইটিং এর ক্ষেত্রে সে যখন ঐহিকে লেখে,আমাদের ভাবনাতেই লেখে। বিরোধ কই?
আর কবিতার এই যে আবহমান আর প্যারালাল বিভাজন,এতেও আমি নিশ্চিত নই। ক্ষণ্ড সময় তো আবহমানেরই অংশ। বাংলাদেশে ডাল খাবার শেষে খায়। পশ্চিমবঙ্গে ডাল খায় খাবার শুরুতে। তাতে  কি তারা পৃথক! সকলেই তো বাঙালী। এক ভাষার সৈনিক। দেখার চোখ, লেখার পদ্ধতি, চিহ্ন, লক্ষণগুলি আলাদা। ক্রিয়াপদ ব্যবহার এক একজনের এক একরকম। বিজ্ঞানের বহু শাখা। সব শাখাই বিজ্ঞানের বিকাশে নিয়োজিত। তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা যে কোনো ক্ষেত্রেই জরুরি। তা অব্যাহত থাকুক।

6.    একজন লেখকের দায় কি ? একজন সম্পাদকেরই বা কী দায় থাকা উচিত বলে তুমি মনে করো ?

## একজন লেখকের দায় তার লেখার প্রতি সৎ থাকা। একজন সম্পাদকের দায় তার সম্পাদনার প্রতি সৎ থাকা। যেমন যে তাঁতি তাঁত বুনছে,নিজ কর্মে সৎ থাকাই তার ধর্ম। আর লেখক ও সম্পাদকের অবশ্যই দায় থাকে তার সমকালের প্রতি।

7.    প্রিন্টেড থেকে অনলাইন।কখনো মনে হয় নি, পত্রিকার গুনগত মান কমতে পারে?

## প্রযুক্তি হল আমার তুণীর। তাকে আধুনিক সমরাস্ত্র্বে সজ্জিত করা সময়ের ধর্ম। আজ কেউ তরবারি নিয়ে আর যুদ্ধ করেনা। সাহিত্য যুদ্ধের অঙ্গনে আরও বহুল বিস্তৃত পৃথিবীব্যপী বাঙালীর কাছে আমাদের পত্রিকার লেখক ও তাদের লেখালিখি পৌঁছে দিতে হবে। তাই অন লাইনে আসা। গুণগত মান কম্প্রোমাইজ করে কাজ করার পক্ষপাতী আমরা নই। তবে আমরা এভাবে ভেবেছি হার্ড কপি হবে ধ্রুপদী ঘরানার। আর অনলাইন লাইট ক্ল্যাসিকাল। নামে লঘু সঙ্গীত হলেও এই জঁরের প্রতিও আমরা শ্রদ্ধাশীল। কিশোর কুমার মান্নাদে কি পন্ডিত যশরাজের থেকে কম কিছু? আমরা অন্তত এ ভাবনায় বিশ্বাসী নই। তাই দুটি ধারাই সমানে চলছে।  

8.    নিজের কোনেকিছু সিদ্ধান্ত, তোমার কখনো ভুল বলে মনে হয়েছে ? বিশেষ করে কলকাতামুখী লেখকদের পিছুটান, আর পৃথিবীব্যাপী লেখকদের সম্ভাবনা কোনদিন ভাবিয়েছে তোমায়?  

## নিজের সব সিদ্ধান্তই ভাবায়। মধ্যবিত্তের সেটাই নেচার। ওই সেকেন্ড থটস্ আছে বলেই পৃথিবীর ইতিহাসে মধ্যবিত্তরাই শিল্প সাহিত্যের চর্চা করে। এমনকি বিপ্লবও মধ্যবিত্তদের হাত ধরেই সংগঠিত হয়েছে। কলকাতামুখী আর পৃথিবীব্যাপী লেখকদের আমি পৃথক দেখিনা। বিন্দু থেকেই সিন্ধুর জন্ম। কলকাতা এই পৃথিবীর ভুগোলেরই একটা অনিবার্য অংশ। তবে কলকাতার সাহিত্য জগৎ অকারণ নিজেকে খুব ওভাররেটেড মনে করে। এটা বিপর্যয়ের সূচনা ঘটায়। আর একটি প্রবণতা হল,সকলেই সবজান্তা,কোনো কোলাহল নেই। যেন মৃত একটা সমাজ। ক্যাওস্ না থাকলে কসমিকের দিকে যাত্রা হবে কীভাবে?

9.    তোমার কখনো এই রকম মনে হয়েছে লেখক কমিউনিটি কোথাও না কোথাও আন-এথিক্যাল্। নিজের লেখা প্রোমোশন করার জন্যই তাঁরা পত্রিকার সাহায্য নেন। সম্পাদককে ইউজ্ করেন। পত্রিকাকে ইউজ্ করেন। পরে , পত্রিকার কথা মনে রাখেন না ?

## এটা লেখক কমিউনিটি বলেই নয়,সামগ্রিক সমাজচিত্র। উদার অর্থনীতি,বিশ্বায়ন মানুষের কাছে যত বিশ্বের দরজা খুলে দিয়েছে,মানুষ মনের দিক থেকে ততই নিউক্লিয়াস্ কেন্দ্রিক হয়েছে। হাম দো হামারা দো। ব্যাস গল্প শেষ। সমাজের নির্মাণ হয়েছিলো পরার্থে বাঁচতে। সে কথাটুকুই মানুষ ভুলে গেছে। কেবলই নিজের ভাবে। বোঝেনা ব্যক্তিকে বাঁচাতেই সমষ্টির প্রয়োজন। লেখককে বাঁচাতেই পত্রিকার বেঁচে থাকা জরুরি। তবে এ সমস্ত কথাই সমাজবদ্ধ মানুষ লেখক প্রসঙ্গে বলছি। যে অসামান্য শক্তিশালী সে তাহিতি দ্বীপে নির্জনে একার সাধনাতেও পৃথিবী কাঁপাতে পারে। তবে সে তো ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম নিয়ে তো আর আলোচনার মানে হয়না।

10.    ঐহিক প্রকাশনা'র নেপথ্য নিয়ে, যদি কিছু বলো

## নিজেদের লেখকরা বই করতে অন্যের কাছে ঘুরবে কেন। আমরাই প্রকাশ করবো। এই ভাবনাতেই তো বহু পত্রিকা আজ প্রকাশনাতেও এসেছে।

11.    তরুন লেখনীকে উৎসাহ দিতে, শুরু করলে "ঐহিক তপতী চ্যাটার্জী পান্ডুলিপি সম্মাননা"; যেখানে পান্ডুলিপি নির্বাচিত হলে, প্রথম বই প্রকাশ করবে সম্পূর্ণ নিজের খরচে ঐহিক। এরকম পুরো খরচ দিয়ে, বই বের করাটা এসময়ে বেশ বিরল।এটা ক্যানো ভাবলে?

## বহু মেধাবী আছেন,যারা মেধা সত্তেও বিকাশে সক্ষম নন। তাঁদের পাশে থাকা। আমার বা আমার দিদির বড় হওয়ার প্রতিটা পদক্ষেপই তো বহু প্রতিবন্ধকতাকে টপকাতে টপকাতেই।এক সময় ক্লান্ত লাগতো। ভেবে দেখলাম আমরা যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি,আমার অনুজরা যেন তার সম্মুখীন না হয়,এ ভাবনাতেই সামান্য ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।


12.    অনেক কিছুর মাঝেও, বাংলা ভাষা কেন্দ্রিক আরো কিছু কাজ; যেমন "ঐহিক সৃজন সম্মান"; "সোমনাথ দাস সম্মাননা" প্রদান প্রতিবছর ঐহিক করছে।একটু যদি বলো বিষয়গুলো আর এসবের কারণ।

## সৃজন সম্মান দেবার কারণ,ঐহিক যে সম্মানগুলি প্রদান করত তা মূলত অগ্রজদের প্রতি সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু তরুণরা তো কিছু দোষ করেনি। সামান্য সম্মান ও কখনও বেঁচে থাকাকে আনন্দময় করে,লেখায় উৎসাহ প্রদান করে। লিখে কি হয়! এ নিরাশা যেন মাথায় চেপে না বসে। আর সোমনাথ দাস সম্মাননার প্রেক্ষিতও প্রায় একই। বহু কৃতি মানুষ রয়েছেন যারা সব্যসাচী। একই সাথে সম্পাদক,প্রকাশক লেখক। এই বিরল গুণী মানুষদের একজন ছিলো আমার ভাই সোমনাথ। তাকে স্মরণ করেই সম্মাননা প্রদান। তাঁরা আরও কাজ করুক। সাহিত্য সমাজ বিকশিত হোক।

13. পত্রিকা / প্রকাশনা ছাড়াও, অন্যান্য সাহিত্যমূলক কাজেও তো ঐহিক যুক্ত।যাঁর মধ্যে ১টি "ঐহিক সাহিত্য সম্মাননা"; যেটি প্রতিবছর দুই বাংলার সাহিত্যকদের দেওয়া হয়।যদিও কৃত্তিবাস আনন্দ পুরষ্কার দেয় বা আরো অনেক লিটিল ম্যাগাজিন বিভিন্ন সম্মাননা দেয়।ঐহিকের এই সম্মাননা দেওয়া বিষয়টি নিয়ে যদি আলোচনা করো। সাথে যদি বলো, একটা পত্রিকা করার পুরস্কার হিসাবে তুমি কি চাও?

## আগেই লিখেছি এক জীবন লিখে একজন মানুষ কিচ্ছুটি পাননি। এমন মানুষই অধিকাংশ। লিখে এ সাহিত্য সমাজের অধিকাংশই অর্থ উপার্জন করেননা। ভালোবাসা থেকেই করেন। তার এত দিনের মেধাশ্রমের বিনিময়ে সে সামান্য সম্মান প্রত্যাশা করে। সেটুকুই বা কই পায় তারা! ক'জনকেই বা দিতে পেরেছি সেই সম্মান। অর্থমূল্য দিতে পারলে ভালো লাগতো। অক্ষম আমরা, পারিনা। অনুজ হিসেবে প্রিয় অগ্রজকে সম্মানটুকু তো দিতে পারি। সেই ভাবনা থেকেই দিই। দিনের পর দিন যে মানুষ মাথা গুঁজে ভুতগ্রস্তের মত লিখে চলেছেন চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছর,তার একদিনের হাসিটা বড় মন ভালো করায়। সামান্যই প্রচেষ্টা, তা নিয়েও কত মানুষ বিরূপ মন্তব্য করে। তাতে কিছু না। আমরা এ কাজটি করে যাবো। এবার থেকে ভেবেছি সমাজ ও শিল্পের অন্যান্য মানুষদেরও সম্মান প্রদান করবো। হাসি ফুটুক তাদেরও।
আমি কিছু প্রত্যাশা করিনা। রাষ্ট্রীয় সম্মান আমরা পেয়েছি। আবার কী প্রত্যাশা করবো! তবে যদি আর একটু ভেবে বলতে বলো : বলব,আমার অনুজদের থেকে সামান্য সম্মান, সম্মাননা নয়, সামান্য শ্রদ্ধা প্রত্যাশা করি। একত্রিশ বছর একটা পত্রিকা প্রকাশ কম কথা নয় কিন্তু  

14.    একাডেমী কতৃক "শ্রেষ্ঠ লিটিল ম্যাগাজিন সম্মাননা" পেয়েছিল ঐহিক, তার 'পাগল' সংখ্যার জন্য।এই বিষয়টা যদি একটু বলো।সাথে তোমার বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিন মেলায় অংশগ্রহণ করা কালীন কিছু মনে রাখার মতো ঘটনাও শুনতে চাই।

## ঐহিকের মুখ ও মুখোশ সংখ্যা প্রকাশ পায় ২০১৩ বইমেলায়। শোনা কথা সেটিও অ্যাকাদেমি কর্তৃক শ্রেষ্ঠ সংখ্যা হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। কোনো অজানা কারণে আমাদের বাতিল করা হয় শেষ মুহুর্তে। এরপর পাগল সংখ্যা করা হল। সেটি এক সর্বাঙ্গীণ ভাবেই সফল কাজ। কাজের বিষয়ে আমাদের খুঁতখুঁতুনি সর্বজনবিদিত। যেমন এবার পোস্ট ট্রুথ সংখ্যার কাজ চলছে। লেখা যা এসেছে তা প্রকাশ করাই যায়। আমরা করিনি। কারণ, কাজটি স্বয়ংসম্পূর্ণতা পায়নি। কাজ করলে এভাবে করাই শ্রেয়। এটা আমার ধারণা। কৌশিক দত্ত(মন ও স্নায়ুচিকিৎসক), ফিজিওলজির অর্ণব স্যার, কবি অমিতাভ মৈত্র, রত্নাবলী রায়, কমলেশ্বর মুখার্জি, গৌতম হালদার সহ আমাদের যারা লেখক; অদ্বয়, অর্ক সহ আরও অনেকের লেখাতেই সেই সংখ্যা সমৃদ্ধ হয়েছিলো। সংখ্যাটি ৩৫৬ পাতার হলেও দু মলাটে বহুবিধ জ্ঞান ভাণ্ডারের এক আকর গ্রন্থ। ফলতঃ পাগল সংখ্যাকে আর ডিসকার্ড করতে পারেনি অ্যাকাদেমি কর্তৃপক্ষ। খবরটা যখন পাই, আমি তখন কাজিরাঙা ফরেস্টে জিপ সাফারিতে। পুরস্কার গ্রহণ করবো কী করবো না, এ নিয়ে প্রাথমিক দোলাচল ছিলো। কারণ তখন যাঁরা সরকারে, তাদের কাজ কর্মের প্রতিফলন আমাদের ভাবনা জগতের সাথে মেলেনা। কিন্তু অগ্রজরা বোঝান। সরকার বাম চালাক বা রাম বা ডান, সেটা সরকার। এভাবে ভাবাটা ঠিক না। বারীনদাসহ বহুজনই  পুরস্কার গ্রহণ করতে বলেন। আমরা গ্রহণে সম্মতি জানাই। পাগল সংখ্যা এত পাঠক প্রিয়তা পায়, যে বহু সংখ্যায় ছেপেও আমরা সকলকে দিতে পারিনি। এখনও মানুষ চায়। তাই পাঁচ বছর পর পাগল সংখ্যা আবার আমরা রিপ্রিন্ট করতে চলেছি।
আর বিভিন্ন জেলার মেলা নিয়ে আমার আলাদা তেমন অভিজ্ঞতা নেই। সারা রাত আড্ডা, সিনিয়র জুনিয়রদের সাথেসাথে বেড়ানো। বন্ধু, অনুজ, অগ্রজদের কাছে আসা। সম্পর্কের নিবিড়তা বৃদ্ধি। এটাও তো অভিজ্ঞতাই।

15.    বাংলাদেশ নিয়ে ১টা কথা প্রায়ই তুমি বলো "৩০ কোটি বাংলাভাষীকে বাদ দিয়ে, বাংলায় সাহিত্য চর্চা হয় না"।এখান থেকেই "ঐহিক বাংলাদেশ"?

## ত্রিশ নয় ১৭ কোটি। অবশ্যই এ কথা সত্য, বাংলাভাষাকে যারা বুকে আগলে, স্বাধীনতার লড়াইতে অগ্রসর হয়, তাদের অস্বীকার করে বাংলা ভাষায় কাজ করা অন্যায়। আর বিভিন্ন সময়ের অনুভূতি, দুই বাংলার প্রায় ২৫ কোটি বাঙালী পরস্পরের সাথে মিলিত হতেই চায়, কিন্তু কোথাও গিয়ে অচেনার দূরত্বটা বড় হয়ে দাঁড়ায়। আর রাষ্ট্রীয় জায়গা থেকে ভারত যেহেতু বড় দেশ, ধারে ভারে বেশি, হয়ত বিগ ব্রাদার এটিটুড্ও দেখিয়ে ফেলে। যদিও সেটার সাথে আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির তেমন যোগ নেই। তবু অবিশ্বাস আছে। সেই অবিশ্বাস ও দূরত্ব কাটানোর সামান্য প্রচেষ্টাও শুরু করা হয় ঐহিক বাংলাদেশের মাধ্যমে। সম্পাদক হিসেবে প্রকৃত দায়িত্ব এবং কবি ও গদ্যকারের যোগ্য নেতৃত্ব সবসময় ভালো কাজে সতত নিযুক্ত থাকুক; আর এই জায়গাতে যার নাম করতেই হয় সে হলো মেঘ অদিতি। একটা আন্তরিক চেষ্টার সূচনা হয়েছে। সফলতা আসতে তো সময় লাগে। দেখা যাক। অপরিচয়ের দূরত্ব কাটুক অন্তত।

16.    ঐহিক আয়োজিত লিটারেরি মিট্ থেকে কোভিড-পর্বের ভার্চুয়াল আড্ডা।এই জার্নিটা যদি আলোচনা করো

## লিটারারি মিট আমাদের এক অতি আশাবাদী প্রচেষ্টা। চালাই লিটল ম্যাগ। অর্থের জোগান কে দেবে? সেটাই সমস্যার। তবু দুবার করা হয়েছে। দেখা যাক কোভিড পরিস্থিতি মিটলে কী পরিস্থিতি দাঁড়ায়। আর ভার্চুয়াল আড্ডাও ঐহিকের সিগনেচার বিষয় ভিত্তিক কাজ মাথায় রেখেই, এখানেও বিষয় ভিত্তিক আড্ডা চলছে। উপস্থিত থাকছে দুই বাংলার অগ্রজ অনুজ কবি গদ্যকারেরা। ভালো সাড়াও পড়েছে বলেই অনুমেয়। আর ঐহিক বাংলাদেশ আরও একটি উদ্যোগ শুরু করেছে। কবি ও সাহিত্যিকদের নিয়ে কথা ও কবিতার ভিডিও আর্কাইভ নির্মাণ। সেটিও একটি সফল উদ্যোগ হিসেবেই পরিগণিত হবে বলেই আশা রাখি।

17.    লিটিল ম্যাগাজিন সংক্রান্ত যেকোনো আলোচনায়, তমাল রায়'কে চাইই চাই।বর্তমানে লিটিল ম্যাগাজিন আরো বেড়েছে।অনেক মেলাও হচ্ছে।পাঠক কি বেড়েছে?

## লিটল ম্যাগাজিন মেলাও করছি আমরা ফোরামের উদ্যোগে। তবে তমাল রায় কে কি খুব একটা কেউ ডাকছে? আমার জ্ঞাতে এমন অভিজ্ঞতা নেই। তবে লিটল ম্যাগের বিস্তৃতি ঘটুক। সে তমাল রায়কে ডাকুক ছাই না ডাকুক। অন লাইন আসার পর লিটল ম্যাগ বিষয়টি একটু ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। প্রতিদিন নতুন ওয়েব বা ব্লগজিন প্রকাশ পাচ্ছে। এঁরা কারা, তাদের কি লিটল ম্যাগ সংক্রান্ত ধ্যান ধারণা আছে? জানা নেই। তবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পাঠক ক্রম বর্ধমান। এটা আশার কথা।

18.    আজকের দিনে পাঠক কে ? আদৌ কি কোন পাঠক আছে ? নাকি সবাই লেখক ?

## পাঠক নিশ্চিত আছে। পটাশপুর বা সামসেরগঞ্জ, কোথায় লুকিয়ে আছে বাংলা ভাষার পাঠক, আমরা তার খোঁজ রাখি কই! সে নিভৃতে আলোর বাইরে থেকে বাংলাভাষার খোঁজ ও চর্চা দুইই করছে। পাঠক আছে, তবেই না এত লেখক। আর লেখক ও তো সে অর্থে পাঠকই।

19.    "নবারুণ ভট্টাচার্য : মনন ও দর্শন"; ঐহিক প্রকাশনায় সাংঘাতিক ১টা কাজ, যেখানে নবারুণ ভট্টাচার্যের ওপর গবেষণাধর্মী বেশ কিছু লেখা সংকলিত আকারে রয়েছে।কাজটার নেপথ্যে থাকা প্রস্তুতিপর্বটা যদি আমাদের জানাও। আর এই কাজটা করলেই বা ক্যানো? এখান থেকেই কি "পোস্ট-ট্রুথ" নিয়ে কাজের চিন্তাভাবনা?

## নবারুণদাকে নিয়ে একটা কাজ আমরা করি তার মৃত্যুর পরেই। আমার সাথে যোগ থাকলেও অদ্বয় ও অর্ক আরও নিবিড় ভাবেই তাঁর লেখা ও মানুষটির কাছের ছিলো। বইটি ওরাই করে,আমরা সাথে ছিলাম। বইটি সত্যি পাঠক মহলে প্রবল সমাদৃত হয়।
নবারুণ ভট্টাচার্যর লেখায় পোস্ট মর্ডান কম্পোনেন্ট হয়তো আছে। কিন্তু পোস্ট ট্রুথ এক বিস্তৃত দর্শন। তার বহুবিধ শাখা। যার একটা পোস্ট মর্ডান লিটারেচার। তাই পোস্ট-ট্রুথ সংখ্যা নবারুণ ভট্টাচার্যর সাহিত্য দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নয়। একেবারেই স্বতন্ত্র উদ্যোগ।

20.    বর্তমানে যেসব তরুণ লেখালিখি করছে; ১জন সাহিত্যিক এবং সম্পাদক হিসেবে, তাদের কোনো বিশেষ বার্তা দিতে চাও?

## বার্তা দেওয়ায় আমি বিশ্বাসী নই। তবে একটি বার্তা সব সময়ের জন্য প্রযোজ্য,তা হল নিজের কাজের প্রতি সৎ থেকো,নিজের সবটুকু উজাড় করে দাও। আর ফলের কথা ভেবো না। সাহিত্যিক কবি সম্পাদক সকলের জন্যই এই কথা এপ্লিকেবল

21.    বাংলা সাহিত্যের ডিজিট্যাল ও এনালগের এমন সন্ধিখনে দাঁড়িয়ে দুবাংলাতেই তুমি ঐহিকের কাজ করছো। একজন সাহিত্য অনুরাগী হিসাবে  নিজেকে কোথায় প্রতিমুহূর্তে দ্যাখো?

## << ফ্রেন্ডস ? ফিলোসফার ? গাইড ? >>
কিছুই না। নিজের কাজ করে যাওয়া একজন একবগ্গা ভাষা সেনানী।

22.    বরাবরই তুমি নিজের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করে জানাও।১জন অক্ষরকর্মীর কাছে, রাজনৈতিক অবস্থান কতোটা গুরুত্বপূর্ণ?

## আমি যা করি, তুমি যা কর বা যে যা করেছে / করছে / করবে, রাজনীতির বাইরে কিছুই না। কেউ তা স্বীকার করে, কেউ করেনা। মানুষ আদ্যন্ত রাজনৈতিক জীব। অরাজনীতিও রাজনীতিই। যে মানুষ কেবল সংসার আর চাকরি করে, যে মানুষ চাষবাস করে ক্ষুন্নিবৃত্তি মিটিয়েই ক্লান্ত, সেও রাজনীতির অংশ জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে।

অনেক অনেক ধন্যবাদ এবং ভালোবাসা তোমায় তমালদা; দেহলিজের জন্য এতোটা সময় দেবার জন্য।

ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা রইলো, দেহলিজের জন্যেও।

দেহলিজের পক্ষ থেকেও ঐহিকের জন্য রইলো অনেক অনেক শুভেচ্ছা এবং শুভকামনা।


No comments

FACEBOOK COMMENT