DEHLIJ

পীযূষকান্তি বিশ্বাস

সম্পাদকীয়




ক্রমে ক্রমে কিনারায় এসে পৌঁছে দেখি, এখনো অনেক দূর সেই কিনারা । ইনফ্যাক্ট  কিনারা এখন একটি উপমা মাত্র, আর এই করোনাকাল যেন শেষ হতেই চায়না  । দূষণগ্রস্থ দিল্লির আকাশ বাতাসের এমনিতেই বদনাম, তার উপর এই কোভিড-১৯ ।  দিল্লির রাস্তাঘাটে ততটাই গতিবেগ লাগাতার । থেমে নেই কিছুই, এটাই দিল্লির নাগরিক চরিত্র ।

 
করোনা কালের প্রারম্ভে দেহলিজ-৫ প্রকাশিত হবার পর, পত্রিকার প্রকাশ ও লেখালেখি নিয়ে একটা থমথমে আবহাওয়া, উচ্চবাচ্য-হীন পঠনপাঠন, করোনা কেড়ে নিয়েছিলো হুল্লোড়ের দিনগুলো । ক্রমে ক্রমে উপনগরীর উপকণ্ঠে ভিড় করেছেন পরিযায়ী শ্রমিক , প্রশ্ন রেখেছেন দিল্লির কাছে , তারা বাড়ি ফিরতে চায় । কেউ বাড়ি ফিরেছেন, কেউ রয়ে গেছেন দিল্লির উপকণ্ঠে, রাজস্থানে, হরিয়ানায় , যাদের ঠিকানা নেই ।

তাদের ঘর হয়ে উঠতে পারেনি দিল্লি । মূল থেকে ছিটকে আসা বাঙালি, জীবিকার উদ্দেশ্যে ছুটে আসা পরিযায়ী মানুষ ।  দিল্লি একটি বিশাল বৃক্ষের প্রশাখার মতো, পরিযায়ী পাখিদের ভিড় দেখি, পক্ষীকুল এসে ক্ষণেক জিরিয়ে নেন ডালে বসে । দুদিনের জন্য তারা ভালোবেসে ফেলেন দিল্লির পত্রপল্লব, রাজধানীর বল্কলে নিজেকে লিখে ফেলেন জৈবনিক উপন্যাসে । তার বুক পকেটে লিখে রাখা ইন্দ্রপ্রস্থের ঠিকানা,  হৃদয়ে ভিজে ওঠা বঙ্গভূমির সুজলা , সুফলা , শ্যামলার টান  । পায়ে যথেষ্ট বিশ্রাম সঞ্চয় হলে, আবার উড়ান দেন সো-কল্ড ঔপন্যাসিক । কার্যপদ্ধতির নাম: ফুড়ুত । যারা উড়ে যেতে চান, উড়ে যেতে পেরেছেন , তারাই হয়ে উঠেছেন দিননায়কের উজ্জ্বল তারকা ।  আর আমরা যারা বেরিয়েছি দিল্লির এপ্রিলে দুপুরে এই পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় , দিল্লির কবিতার তল্লাসে, মা কসম – এখানে আমরাও প্রত্যাশিত ভাবে পেয়েছে আশফল্টের নির্জীবতা , কোন প্রাণ পাইনি । কিন্তু সো-কল্ড পাখির মতো উড়ে যেতেও পারিনি । বরং জড়িয়ে গেছি লতায়, পাতায়, সবুজে, কণ্টকে, আরাবল্লির অজানা বৃক্ষের অচেনা জীবন-শৈলীতে ।  উড়ে যেতে না পারার নাম কি দিতে পারি ? অক্ষমতা ? নাকি সৃষ্টি-বীজ ?  ফেলেরাখা জমির উপর যে কৃষক ঘৃণা ভরে রেখে গেলো উদাসীন নজর, এই গরমের জুন জুলাইয়ের কিঞ্চিত বর্ষা তাদের দিয়েছে অঙ্কুরোদগমের মসম । কোন পরিচর্যা ছাড়াই শ্যামলিমায় ফুলে ওঠে যে ফসলের শিষ, তার অলক্ষ্যে পরিপক্ব হয়ে ওঠার নাম দেহলিজ । 

আসফল্টের পাথর জমি ফাটিয়ে মাথা উঁচু করে নিজের পল্লব মেলে দিতে পারার নাম দেহলিজ , আন্তঃপ্রজাতির অস্তিত্ব সংগ্রামে নিজদের শিকড় বিছিয়ে দেবার নাম দিল্লির কবিতা,  দিল্লি নিজেই কিছু তার জবরদস্তী করেনি ।  আপনি হতেই পারেন সুজলা সুফলা, তাতে কোন আমাদের আপত্তি নেই, কিন্তু আমার আরাবল্লী রুষ্ক, আমার রাইপিথোরা বঞ্জর এই কথা কেন বারবার বলে রুঢতার পরিচয় দেওয়া ?

দেহলিজের ষষ্ঠ সংখ্যার প্রকাশ হলো ।  দেহলিজ সেজে উঠেছে বঙ্গ লেখনীতে , সঙ্গে হিন্দি ও লোকাল ইংরাজী । কসমোপলিটানের যান্ত্রিক পরিকাঠামোয় যুক্ত হয়েছে অনলাইন সাহিত্য প্রয়াস । অনলাইন সাহিত্যের নাম শুনতেই যে সাহিত্য অনুরারাগীদের যাদের কুচকে যেতো নাক, পাড়ায় পাড়ায় টিটকারি আর হাসিহাসির রোল পড়ে যেতো, তাদেরকেও আজ অনলাইন দেখছি । কেউ কেউ আবার ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন এই যে আমি আজ অমুক অনুষ্ঠানে ছিলাম, আমি কাল অমুক টিভিতে কবিতা পড়বো । অনলাইন আসা না কোন ক্রেডিটের ব্যাপার, না কোন ডিসক্রেডিটের ব্যাপার । বরং আমরা তাকে জলভাতের সঙ্গে তুলনা করতে পারি । ওপেন ফোরামে ক্রিয়েটিভ আর্টের চর্চা হোক, চিন্তার বিস্তার হোক, চেতনা উন্মেষ হোক । এই দিল্লিতে কিছু হচ্ছে না বলে যাদের কাছেও একটা প্রশ্ন রাখা যাক, তারা ‘কিছু’ করে ওঠার কোন পর্যায়ে আছেন ?

আসলে, অনলাইন সাহিত্য একটা পরিচর্যাহীন বেড়ে ওঠার নাম । সেখানে অভিভাবকত্ব করার লোভ সংবরণ করতে পারেন না স্বঘোষিত মাস্টারমশাইগণ । ঐ গেলো গেলো করে, নিজেও যে পুলিশ তাকে ধরতে দৌড়ালো না , কাল দেখি সে রেড লাইটে দাঁড়িয়ে পকেট ভর্তি নোট গুনছেন । তিনি আবার মাস্টারমশাই ও । প্রিন্ট মিডিয়ার বহু মাস্টার মশাইয়ের নজর এখন দিল্লিতে ।  শুধু দিল্লি কেন, প্রিন্ট মিডিয়া খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই পাপলুকে যাকে পাশ করিয়ে দেওয়া যায় ।  পত্রিকা পড়ে দিন কাটানোর দিন আর কতদিন ? পাঠক তৈরির কথা আপনারা বারবার বলছেন আর নিজেকে ভেবে নিয়েছেন তাদের কাণ্ডারি । একটু হুঁশিয়ার মাস্টারমশাই । পাঠক আর নির্ভেজাল পাঠক নেই, ক্লায়েন্ট আর ক্যাশলেস ক্লায়েন্ট নেই, নেটওয়ার্কের প্রত্যেকটি নোডে তা একটি সার্ভার নোড । প্রত্যেকটি রেডিও এখন নিজেই ট্রান্সমিটার ।  আপনি তার ট্রান্সমিশন কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন তার জন্য প্রয়োজন একটি রেডিও মাত্র, কোন আকাশবাণী নয় ।

এই কথা বলেছিলো তারে, চাঁদ ডুবে গেলে অদ্ভুত আঁধারে , কালীবাড়ির সামনে পাতা ও প্রশাখায় অলক্ষ্যে বেড়ে ওঠা ভেন্ডারার গাছ ।  এই শহরে বেড়ে ওঠা কংক্রিটের জঙ্গল তখনো ভাবেন মঙ্গলবারের কথা ।  আমরা যারা বেরিয়েছি চাঁদ ধরতে-  কখনো হাতে হাত, হোয়াটস এপে হোয়াটস এপ, ফেসবুকে ফেসবুক – একটা বক্তব্যই, পরিষ্কার বলতে চাইঃ ধুয়ে ফেলুন । ধরা যাক নতুন করে হাত ।  এই দীর্ঘ রজনীতে, দেহলিজের আকাশে চাঁদসহ আরো কিছু তারকার দেখা হওয়া বাকি । তারজন্য কোন টেলিস্কোপের দরকার নেই ।

 

6 comments:

  1. Excellent. Book chitye lekha. Andhakare o aalor janya sandhani chokh

    ReplyDelete
  2. দুর্দান্ত সম্পাদকীয়

    ReplyDelete
  3. দেহলিজ এগিয়ে চলুক। ❤

    ReplyDelete
  4. দেহলিজ এগিয়ে চলুক। ❤

    ReplyDelete
  5. দুরন্ত সম্পাদকীয়।এরকম ধাসু লেখা পড়ার জন্যই বারবার ছোটাছুটি থেকে যায়

    ReplyDelete

FACEBOOK COMMENT